মাহফুজুর রহমান সাইমন, শেরপুর:
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে শেরপুরের তিনটি সংসদীয় আসনে রাজনীতির মাঠ বেশ সরগরম। মূলত বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলেও দুই আসনে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিএনপির জন্য বাড়তি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছেন। পাশাপাশি একটি আসনে এবি পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রয়াত জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ছেলের অংশগ্রহণ ভোটের হিসাবকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে শেরপুর-১, ২ ও ৩—এই তিনটি আসনেই চলছে নতুন সমীকরণের রাজনীতি।
শেরপুর-২ (নকলা-নালিতাবাড়ী) আসনটি দীর্ঘদিন ধরে প্রয়াত সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কারণে আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এ আসনে একমাত্র ২০০১ সালেই বিএনপি জয় পেয়েছিল। সেই নির্বাচনে মতিয়া চৌধুরীকে পরাজিত করেন জাহেদ আলী চৌধুরী, যিনি পরে জাতীয় সংসদের হুইপ হন। এবার বাবার সেই হারানো আসন পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে মাঠে নেমেছেন তাঁর ছেলে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক প্রকৌশলী ফাহিম চৌধুরী।
এ আসনে জামায়াত প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন জেলা জামায়াতের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মু. গোলাম কিবরিয়া। পাশাপাশি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গণঅভ্যুত্থানে আহত জুলাইযোদ্ধা খোকন চন্দ্র বর্মণকে, গণঅধিকার পরিষদ কাজী হায়াতকে এবং এবি পার্টি আবদুল্লাহ বাদশাকে প্রার্থী করেছে।
ভোটারদের অভিযোগ, তপশিল ঘোষণার আগেই বড় দলগুলোর প্রার্থীরা আচরণবিধি উপেক্ষা করে শোডাউন, সভা-সমাবেশ ও বিভিন্ন সামাজিক-ধর্মীয় কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। নানা প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা চলছে।
নালিতাবাড়ী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গারো পাহাড় ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বসবাস। গারো, কোচ, হাজং, বানাই ও বর্মণ জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি হিন্দু ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য ভোট এ আসনের ফলাফলে বড় ভূমিকা রাখে। প্রয়াত জাহেদ আলী চৌধুরীর সঙ্গে এ জনগোষ্ঠীর ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সেই ধারাবাহিকতায় ফাহিম চৌধুরী পাহাড় ও সমতলের ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন।
ফাহিম চৌধুরী বলেন, “বাবার রেখে যাওয়া অবদানের প্রতিদান দিতে মানুষ মুখিয়ে আছে। ধানের শীষের প্রতি যে ভালোবাসা দেখছি, তাতে আমি অভিভূত।”
জামায়াত প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া জানান, মাঠে গণসংযোগে বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাচ্ছেন।
নকলা চন্দ্রকোনা কলেজের অধ্যক্ষ খন্দকার আরিফুল আল মরবিনের মতে, “এ আসনে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। আওয়ামী লীগের ভোটাররা আপাতত নীরব—শেষ মুহূর্তে তারা কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটাই বড় প্রশ্ন।”
শেরপুর-১ (সদর) আসনে বিএনপি জয় পেয়েছিল সর্বশেষ ১৯৭৯ সালে। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে আসনটি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির দখলে ছিল। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে এবার আসনটি পুনরুদ্ধারে বিএনপি ভরসা রাখছে দলের সর্বকনিষ্ঠ নারী প্রার্থী ডা. সানসিলা জেবরিন প্রিয়াঙ্কার ওপর। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি সাবেক হুইপ আতিউর রহমানকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলেছিলেন।
এ আসনে জামায়াত প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি হাফেজ রাশেদুল ইসলাম। একই সঙ্গে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শফিকুল ইসলাম মাসুদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন, যা বিএনপির ভোটে ভাঙন ধরাতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। এনসিপি প্রার্থী করেছে ইঞ্জিনিয়ার লিখন মিয়াকে। আর এবি পার্টির হয়ে প্রচারণায় আছেন প্রয়াত জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ছেলে হাসান ইমাম ওয়াফি।
ডা. প্রিয়াঙ্কা বলেন, “১৭ বছর পর মানুষ যেন নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে, সেটাই আমার প্রধান চাওয়া। নারী শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই আমার লক্ষ্য।”
অন্যদিকে শফিকুল ইসলাম মাসুদ সংক্ষিপ্তভাবে জানান, তিনি নির্বাচন করবেন—এটাই চূড়ান্ত।
জামায়াত প্রার্থী হাফেজ রাশেদুল ইসলাম বলেন, “দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, চাঁদাবাজমুক্ত পরিবেশ ও শিক্ষার হার বাড়ানোই আমার অগ্রাধিকার।”
শেরপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুর রশিদ মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া গণতান্ত্রিক ধারার স্থায়িত্ব সম্ভব নয়।
শেরপুর-৩ আসনটি শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলা নিয়ে গঠিত। গারো পাহাড়, গজনী পর্যটন কেন্দ্র ও রাজাপাহাড় এ অঞ্চলের পরিচিত নাম। হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব এখানকার অন্যতম বড় সমস্যা। গত চার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও এবার মাঠে নেমেছেন বিএনপির সাবেক এমপি মাহমুদুল হক রুবেল। জামায়াত প্রার্থী জেলা সেক্রেটারি নূরুজ্জামান বাদল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন ঝিনাইগাতী উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাদশা।
মাহমুদুল হক রুবেল বলেন, “১৭ বছরে হাতি-মানুষ দ্বন্দ্ব ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিরসনে দৃশ্যমান কাজ হয়নি। নির্বাচিত হলে এসব সমস্যার বাস্তব সমাধান হবে।”
জামায়াতের নূরুজ্জামান বাদল জানান, তিনি সৎ নেতৃত্ব ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে কাজ করবেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল ইসলাম বাদশার ভাষ্য, “৫৩ বছর ধরে অবহেলিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠাই আমার লক্ষ্য।”
সব মিলিয়ে শেরপুরের তিন আসনেই বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি স্বতন্ত্র ও ছোট দলের প্রার্থীদের উপস্থিতি ভোটের সমীকরণকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। শেষ পর্যন্ত ভোটারদের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে—কার হাতে যাবে শেরপুরের সংসদীয় আসনগুলো।