
শরিফা বেগম শিউলী, স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর
রংপুরে সাংবাদিক লিয়াকত আলী বাদলের ওপর প্রকাশ্যে সন্ত্রাসীভাবে হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ সংবাদজগত মঙ্গলবার (২২ সেপ্টেম্বর) রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে শতাধিক সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মী মিছিল, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) উম্মে ফাতেমার অপসারণ না হলে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দেন অনতিবিলম্বে তারা।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত লিয়াকত আলী বাদলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন “রংপুরে জুলাই যোদ্ধাদের নামে অটোরিকশার লাইসেন্স, পাঁচ কোটি টাকা বাণিজ্যের পাঁয়তারা” শিরোনামে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, يوليو যোদ্ধা ও রাজবন্দিদের নামে ভুয়া তালিকা তৈরি করে গোপনে ৫০০টি নিষিদ্ধ অটোরিকশার লাইসেন্স ইস্যু করে পাঁচ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে—এর লাগি অভিযোগ তোলা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই স্থানীয় কিছুমান স্বার্থান্বেষী মহল ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বলে মনে করা হচ্ছে।
ঘটনার বিবরণ অনুসারে, রবিবার (২১ সেপ্টেম্বর) সকালে কাঁচারী বাজার এলাকায় পুলিশ সুপার কার্যালয় সংলগ্ন স্থান হতে সাংবাদিক লিয়াকত আলী বাদলকে তুলে নেয় একদল সন্ত্রাসী। পরে তাঁকে প্রকাশ্যে মারধর করে একটি অটোরিকশায় তুলে ধরে মারে–ধাক্কা দিয়ে নগরীর সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সিইওর কক্ষে তাকে বসিয়ে সংবাদ প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেওয়া হয়; বাদল যখন সংবাদ প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করেন তখন তাকে জোর করে আটক করে রাখা হয়। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ও সহকর্মী সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে এসে তাকে উদ্ধার করেন।
ঘটনাটি নিশ্চিত হওয়া মাত্রই রংপুরের প্রবীণ ও তরুণ সাংবাদিকরা ক্ষোভের সঙ্গে এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানান। রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধন ও বিক্ষোভে রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়ন (আরপিইউজে), রংপুর প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ক্লাব, সিটি প্রেসক্লাব, ভিডিও জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, টেলিভিশন ক্যামেরা জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, অনলাইন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনসহ জেলা ও উপজেলার প্রায় সব সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা অংশ নেন।
মানববন্ধনে বক্তব্য দেন রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সালেকুজ্জামান সালেকুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল মান্নান, রংপুর রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি শরিফা বেগম শিউলী, রংপুর সিটি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর মানিক, রিপোর্টার্স ক্লাবের সভাপতি শাহ বায়েজীদ আহামেদ, প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মাহবুব রহমানসহ আরও অনেকে। বক্তারা একেধারে বলেন, “সাংবাদিকের ওপর হামলা মানে গণমাধ্যম ও সংবাদপ্রসূত গণতন্ত্রের ওপর হামলা।” তাঁরা হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও সিইওকে অবিলম্বে অপসারণ দাবি করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হলে রাজপথে নামার ঘোষণা দেন।
মানববন্ধনে আক্রান্ত সাংবাদিক লিয়াকত আলী বাদল বলেন, “আমি কোন ক্ষমতার কাছে সংবাদ প্রত্যাহারে যাবে না। সংবাদ সত্য যদি জনগণের সামনে না পৌঁছায় তাহলে ক্ষমতাশীলদের সামাজিক জবাবদিহি থাকবে না।” অন্যান্যের বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়, প্রশাসন-নির্ভর সুবিচারই এই ধরনের হামলা রোধ করতে পারে—অতএব দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, মানববন্ধন চলাকালীন সিটি করপোরেশনের একদল কর্মচারীও পাল্টা আচরণ করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে দেয়; পরিস্থিতি এমনবারে পৌঁছায় যে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি শান্ত করতে হয়। ওই দিন বিকেলে রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রশাসনের এক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে রংপুর প্রেসক্লাবের প্রশাসক রমিজ আলম সভা পরিচালনা করেন; রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ও বিপুল সংখ্যক সংবাদকর্মী এতে অংশ নেন। আলোচনায় সাংবাদিকরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার দাবি জানান। তবে বৈঠকে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
সমাবেশে সকল অংশগ্রহণকারী সংস্থা এক কণ্ঠে জানায়—“আসামিদের গ্রেপ্তার না মানলে, সিইওকে অপসারণ না করলে আমরা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে অটোরিকশার লাইসেন্স বানিজ্যচক্রের বিরুদ্ধে ও গণমাধ্যমে হামলার বিরুদ্ধে আরও শক্ত ও সমন্বিত কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব।” একই সঙ্গে ঘোষণা করা হয়—নির্দিষ্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি পূরণ না হলে বুধবার রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয় সরাসরি ঘেরাও করা হবে এবং প্রয়োজনে সারাদেশের সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃহত্তর আন্দোলনে যাবে।
এ ঘটনার ফলে রংপুর জেলায় সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল ও টেলিভিশন চ্যানেলে ব্যাপক প্রতিবাদভাবনা ও সমর্থনের ঢেউ দেখা গেছে। স্থানীয় গবেষক ও মানবাধিকারকর্মীরা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষায় প্রশাসনিক ব্যবস্থা জরুরি বলে মনে করছেন।
অবশেষে, মানববন্ধনকারী সাংবাদিকরা প্রশাসনের কাছে দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন এবং বলেছেন—গণমাধ্যমকে নির্দ্বিধায় কথ্য ও লিখিত সত্য উদঘাটন করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, আর তা না হলে গণতন্ত্র ও জনগণের তথ্য অধিকারই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।