
বিশেষ প্রতিবেদন | ঢাকা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে যে কজন ব্যক্তিত্ব অদম্য সাহস আর আপসহীন নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় নাম বেগম খালেদা জিয়া। একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে সেনাপত্নী, আর সেখান থেকে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার গল্পটি কোনো উপন্যাসের চেয়ে কম নয়। আজ তাঁর প্রয়াণে অবসান হলো চার দশকের এক বর্ণাঢ্য ও কণ্টকাকীর্ণ রাজনৈতিক অধ্যায়ের।
১৯৪৫ সালে দিনাজপুরে জন্ম নেওয়া খালেদা খানম পুতুলের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় এক বিষাদময় পরিস্থিতিতে। ১৯৮১ সালে স্বামী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির অস্তিত্ব যখন সংকটের মুখে, তখন দলের হাল ধরতে রাজনীতিতে পা রাখেন তিনি। ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর এই যাত্রা। ১৯৮৪ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার ভূমিকা তাকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। দীর্ঘ ৯ বছরের আন্দোলনে তিনি বারবার কারাবরণ করেছেন, কিন্তু মাথা নত করেননি। তাঁর এই অনমনীয় অবস্থানই ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানকে ত্বরান্বিত করেছিল এবং দেশে গণতন্ত্রের পুনরুত্থান ঘটিয়েছিল।
১৯৯১ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন খালেদা জিয়া। তাঁর সময়েই দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন ঘটে। এরপর ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালেও তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মোট তিন মেয়াদে তিনি দেশের শাসনভার পরিচালনা করেছেন।
বেগম জিয়ার শাসনামল বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে:
নারী শিক্ষা: মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তি চালু।
উন্নয়ন: অবকাঠামো উন্নয়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রসার।
প্রতিরক্ষা: জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ আরও শক্তিশালী করা।
যমুনা সেতু: দেশের অন্যতম বৃহৎ যমুনা বহুমুখী সেতুর কাজ সম্পন্ন ও উদ্বোধন।
রাজনৈতিক জীবনের শেষ দেড় দশক বেগম জিয়ার জন্য ছিল চরম অগ্নিপরীক্ষার। ১/১১ পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালে তাকে কারাগারে যেতে হয়। পরবর্তী সময়ে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সরকারের নির্বাহী আদেশে তিনি নিজ বাসায় অন্তরীণ ছিলেন। বারবার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার আবেদন করা হলেও রাজনৈতিক ও আইনি জটিলতায় তা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ রোগভোগের পর আজ ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫-এ চিরবিদায় নিলেন এই মহীয়সী নারী।
বেগম খালেদা জিয়া কেবল একটি দলের নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন কোটি মানুষের আবেগ। জেল-জুলুম, ব্যক্তিগত বিয়োগব্যথা আর শারীরিক অসুস্থতা—কোনো কিছুই তাঁর জনপ্রিয়তায় চির ধরাতে পারেনি। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে তাঁর নাম লেখা থাকবে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা এক অকুতোভয় সেনানী হিসেবে।