মুহাম্মদ আবু হেলাল, শেরপুর প্রতিনিধি :
শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী সীমান্তে বিশেষ অভিযানে প্রায় ১০ লক্ষাধিক টাকার ভারতীয় চোরাচালানি মালামাল ও মাদকদ্রব্য জব্দ করেছে ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন (৩৯ বিজিবি)। বুধবার (২৭ আগস্ট) রাতভর টানা অভিযানের মাধ্যমে এসব মালামাল উদ্ধার করা হয়।
অভিযান পরিচালনার বিষয়ে ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মেহেদি হাসান গণমাধ্যমকে জানান, সীমান্ত এলাকায় অবৈধভাবে ভারতীয় পণ্য ও মাদক প্রবেশের চেষ্টা চালানো হলে বিজিবি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তৎপর হয়। অভিযানে ভারতীয় শাড়ি, লুঙ্গি, শার্ট পিস, জুস, সুপারি, কসমেটিকস, প্রসাধনী সামগ্রীসহ বিভিন্ন ধরনের চোরাচালানি পণ্য জব্দ করা হয়। এর সঙ্গে পাওয়া যায় ১০০ বোতল ভারতীয় ফেন্সিডিল ও ২ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট। এসব মালামালের আনুমানিক বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ১০ লক্ষ ৩৯ হাজার ৮শত টাকা।
তিনি আরও জানান, চোরাকারবারিরা বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তবে সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে এবং জব্দকৃত মালামাল সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
শেরপুর সীমান্ত এলাকা দীর্ঘদিন ধরেই চোরাচালানকারীদের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে ভারতীয় পণ্য ও মাদকদ্রব্য সহজে প্রবেশের কারণে সীমান্ত জনপদগুলোতে বিভিন্ন সময় অভিযান চালানো হলেও চোরাচালানের প্রবণতা থামছে না। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে একশ্রেণির চক্র নিয়মিত এসব অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারা স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও দালালের মাধ্যমে ভারত থেকে এসব পণ্য এনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করে থাকে।
আটককৃত মালামালের মধ্যে ফেন্সিডিল ও ইয়াবা সবচেয়ে আলোচিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দুই ধরনের মাদক তরুণ সমাজকে ভয়াবহভাবে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে। বিজিবির অভিযানে এগুলো আটক হওয়ায় স্থানীয় অভিভাবকরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের দাবি, শুধু অভিযান নয়, সীমান্তে স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। কারণ মাদকের সহজলভ্যতা কমাতে না পারলে যুব সমাজকে এই ক্ষতিকর নেশা থেকে রক্ষা করা কঠিন হবে।
বিজিবি সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিনই সীমান্ত এলাকায় ছোট-বড় নানা ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হয়। কখনও চোরাচালানকারীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়, আবার কখনও সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে যায় তারা। সম্প্রতি সীমান্তে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তাপ ক্যামেরা, ড্রোন ও আধুনিক টহল ব্যবস্থার মাধ্যমে অবৈধ প্রবেশ রোধে চেষ্টা চলছে।
লে. কর্নেল মেহেদি হাসান জানান, বিজিবি সবসময় সীমান্ত নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে। সীমান্ত জনগণের সহযোগিতা ছাড়া এই চোরাচালান রোধ সম্ভব নয়। তিনি স্থানীয় জনগণকে আহ্বান জানান, চোরাচালান ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে তথ্য দিয়ে বিজিবিকে সহযোগিতা করার জন্য।
নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী সীমান্তের বাসিন্দারা জানান, প্রায় প্রতিদিনই তারা চোরাচালানের মতো কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন। মাঝে মাঝে বিজিবির অভিযানে এসব মালামাল জব্দ হলেও আসল চোরাকারবারিরা ধরা পড়ে না। এতে সীমান্ত এলাকায় অপরাধ চক্র সক্রিয় থেকে যাচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মনে করেন, সীমান্ত এলাকায় বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হলে চোরাচালান পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব নয়।
বিজিবি জানায়, আটককৃত সব মালামাল শেরপুর জেলার সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হবে এবং আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধ্বংস বা নিলাম করা হবে। মাদকদ্রব্যের ক্ষেত্রে পৃথক মামলাও দায়ের করা হবে।
শেরপুর সীমান্তে বিজিবির সাম্প্রতিক অভিযান আবারও প্রমাণ করেছে যে সীমান্ত এলাকা এখনো চোরাচালান ও মাদকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এই অভিযানে বিপুল পরিমাণ মালামাল আটক হওয়ায় সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদারের প্রমাণ মিললেও প্রশ্ন রয়ে যায়, মূল চক্র ধরা না পড়লে কতটা কার্যকর হবে এসব পদক্ষেপ? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্ত এলাকায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে—বিজিবি, পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন এবং জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
বিজিবির এ অভিযান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এতে প্রমাণ হয় সীমান্ত নিরাপত্তায় বাহিনী সর্বদা সক্রিয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই সমস্যার সমাধান চাইলে প্রয়োজন কঠোর আইন প্রয়োগ, চোরাচালানকারীদের শনাক্তকরণ এবং মাদকদ্রব্যের সহজ প্রবেশপথ বন্ধ করা। নচেৎ সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান ও মাদক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।