সীমান্ত জনপদে মানব-হাতি দ্বন্দ্বের দীর্ঘ ইতিহাস, বন বিভাগের উদ্যোগে ক্ষতিপূরণের চেক বিতরণ
মুহাম্মদ আবু হেলাল, শেরপুর প্রতিনিধি:
শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী বালিজুরি অঞ্চলে ভারতীয় বনাঞ্চল থেকে লোকালয়ে নেমে আসা বন্য হাতির তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত ২৩টি পরিবারের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তর করেছে ময়মনসিংহ বন বিভাগ।
বুধবার (১৬ জুলাই) দুপুরে উপজেলার বালিজুরী রেঞ্জ অফিস প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে এসব চেক বিতরণ করা হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জাবের আহমেদ। রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. সুমন মিয়ার সভাপতিত্বে আয়োজিত এই আয়োজনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে মোট ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল্যের চেক হস্তান্তর করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন—
বালিজুরি সদর বিট কর্মকর্তা আব্দুর রাকিব
বন বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তা ও স্টাফ
ইআরটি (ইলিফ্যান্ট রেসপন্স টিম) দলের সদস্যরা
সামাজিক বনায়নের উপকারভোগী
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য
স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও গণমাধ্যম কর্মীরা
সীমান্তবর্তী পাহাড়ি জনপদ শ্রীবরদীর বালিজুরি, ঝগড়ারচর, মাঝিপাড়া, গোয়াসি, সাতানী এবং রাজাপাহাড় এলাকায় বন্য হাতির উপদ্রব দীর্ঘদিনের। মূলত ভারতীয় বনাঞ্চল মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় থেকে খাবারের সন্ধানে হাতির দল নেমে আসে বাংলাদেশ অংশে। ফসলি জমি ধ্বংস, কাঁচা ঘরবাড়ি ভাঙচুর, গবাদিপশু মারার মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটে। এর ফলে এসব এলাকার মানুষ প্রতিনিয়ত আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে।
রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. সুমন মিয়া বলেন,
“মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে আমাদের পক্ষ থেকে নিয়মিত মনিটরিং এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই রাজাপাহাড় এলাকায় ৪০ একর জমিতে একটি বন্য হাতির আবাসস্থল নির্মাণ করা হচ্ছে, যাতে তারা নির্দিষ্ট এলাকায় থাকেন এবং লোকালয়ে নেমে না আসেন।”
তিনি আরও জানান,
“বন্য হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত যেকোনো ব্যক্তি বন নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন করলে, আমরা তা যাচাই-বাছাই করে নির্ধারিত অনুদান দিয়ে থাকি। এর জন্য এলাকাবাসীর সহযোগিতা ও সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
অনুদান বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো তাদের ক্ষতির বিবরণ দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কারও ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, কেউ গবাদিপশু হারিয়েছেন, কারও পরিবারে মৃত্যুও ঘটেছে পূর্বে। ক্ষতিগ্রস্ত মজিবুর রহমান বলেন,
“গত বৈশাখে হাতির দল আমার গরুটাকে মেরে ফেলে। আর ঘরের অর্ধেকটা ভেঙে যায়। তখন পরিবার নিয়ে মাঠে গিয়ে রাত কাটাতে হয়েছিল। এই অনুদান কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে।”
আসিয়া খাতুন নামের আরেক নারী বলেন,
“আমার স্বামী নেই, একমাত্র ছেলেটার পড়ালেখার খরচ চালাতে গিয়ে হাতে টাকা ছিল না। এখন এই টাকাটা দিয়ে অন্তত ঘরের চালটা ঠিক করতে পারবো।”
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জাবের আহমেদ বলেন,
“এই অঞ্চলের মানুষ অত্যন্ত সাহসী। সীমান্তবর্তী এমন জটিল পরিবেশে থেকেও তারা দিনের পর দিন লড়াই করে যাচ্ছেন। সরকার সবসময় মানুষের পাশে আছে, থাকবে। তবে বন আইন মেনে চলতে হবে। যে কোন সমস্যা হলে দ্রুত প্রশাসন বা বন বিভাগকে জানাতে হবে।”
তিনি আরও বলেন,
“আমরা চাই না কোন পরিবার আর হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হোক। তাই সচেতনতা এবং দায়িত্বশীল আচরণ জরুরি।”
অনুষ্ঠানে বারবারই বন আইন ও পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়। বক্তারা বলেন, মানুষের বসতির এলাকা যখন বন্য প্রাণীর আবাসস্থলে অনুপ্রবেশ করে, তখন সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। এজন্য পরিকল্পিত বন ব্যবস্থাপনা এবং বিকল্প খাদ্য উৎস নিশ্চিত করলেই এই সংকটের সমাধান হতে পারে।
বালিজুরী রেঞ্জ কর্মকর্তা আরও জানান,
রাজাপাহাড় এলাকায় হাতির করিডোর চিহ্নিত করা হচ্ছে
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ইআরটি (Elephant Response Team) গড়ে তোলা হয়েছে
বন পাহাড়ে আরও বাগান স্থাপন করে হাতির খাদ্য সংকট দূর করার চেষ্টা চলছে
স্থানীয় জনসচেতনতামূলক সভা ও লিফলেট বিতরণের কার্যক্রম অব্যাহত আছে
স্থানীয় সাংবাদিক রুহুল আমিন বলেন,
“এই চেক বিতরণ কেবল একটি সাহায্য নয়, এটা রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। কিন্তু আমাদের এলাকাবাসী আরও প্রশিক্ষিত হলে তারা নিজেরাও এই সংকট মোকাবিলা করতে পারবে।”
স্থানীয় সমাজসেবক নুরুল ইসলাম বলেন,
“সরকারি এই অনুদান অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান— যেখানে মানুষ আর হাতি উভয়েই নিরাপদে সহাবস্থান করতে পারে।”
শ্রীবরদীর সীমান্তবর্তী জনপদে হাতির উপদ্রব আর নতুন কিছু নয়। কিন্তু মানুষ যেন শুধু ক্ষতির মুখেই না পড়ে, বরং রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ঘুরে দাঁড়াতে পারে— এই আয়োজন তারই এক প্রমাণ। বন বিভাগের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, তবে তা যেন ধারাবাহিক হয় এবং আরও সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে টেকসই সমাধানে পৌঁছায়— এটাই এখন এলাকাবাসীর প্রত্যাশা।