আবুল হাশেম, রাজশাহী ব্যুরো:
রাজশাহীতে সেনাবাহিনীতে চাকরি দেওয়ার প্রলোভনে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রতারক চক্রের মূলহোতা মোঃ রাজিউর রহমান (৪০) অবশেষে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে ভূয়া পুলিশ পরিচয়ে সাধারণ মানুষকে চাকরি দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতারণা করে আসছিল এই ব্যক্তি।
ঠাকুরগাঁও জেলার সদর থানার বন্দরপাড়া এলাকায় র্যাব-৫ এবং র্যাব-১৩ এর একটি যৌথ আভিযানিক দল গতকাল (১২ জুলাই ২০২৫) সন্ধ্যায় অভিযান চালিয়ে মোঃ রাজিউর রহমানকে গ্রেফতার করে। তিনি ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার জনগাঁও গ্রামের বাসিন্দা।
প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগী একজন যুবক সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে চাকরির জন্য অনলাইনে আবেদন করার পর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে জানতে পারেন, মোঃ রাজিউর রহমান নামের এক ব্যক্তি নিজেকে পুলিশের এসআই পরিচয়ে বিভিন্ন সরকারি চাকরিতে লোকজন ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এরপর চাকরির আশায় ভুক্তভোগী রাজিউরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
রাজিউর নিজেকে ঠাকুরগাঁও জেলায় কর্মরত পুলিশ এসআই পরিচয় দিয়ে দাবি করে, তিনি আগে বহুজনকে সেনাবাহিনীতে চাকরি দিয়েছেন এবং তাকেও চাকরি পাইয়ে দিতে পারবেন। এ জন্য রাজিউর ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরির আশ্বাস দেন। প্রাথমিকভাবে ৬ লাখ টাকা এবং নিয়োগপত্র পাওয়ার পর আরও ৬ লাখ টাকা দিতে হবে—এমন চুক্তিতেই লেনদেন শুরু হয়।
২০২৫ সালের ৩১ মে ভুক্তভোগী তার মোবাইলে সেনাবাহিনীর মাঠে উপস্থিত হওয়ার একটি এসএমএস পেলে, তা রাজিউরকে জানান। এরপর ২ জুন রাজিউর তাকে নির্দেশ দেন, জনতা ব্যাংকের দুটি ব্ল্যাঙ্ক চেক, মূল এসএসসি সনদ, ছয়টি নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ঠাকুরগাঁও ঠিকানায় পাঠাতে।
ভুক্তভোগী সেই নির্দেশ অনুযায়ী এসব মূল্যবান কাগজ এসএ পরিবহনের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেন। রাজিউর জানায়, রাজশাহী সেনানিবাসে সৈনিক পদে নিয়োগের জন্য সকাল সাড়ে সাতটায় মাঠে উপস্থিত হতে হবে।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রাথমিক বাছাইপর্বেই ভুক্তভোগী বাদ পড়ে যান। এরপর রাজিউরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গেলে তিনি সাড়া দেননি। মোবাইল নম্বর বন্ধ পেয়ে সন্দেহ দানা বাঁধে এবং পরে ভুক্তভোগী বোয়ালিয়া থানায় একটি প্রতারণার মামলা করেন।
মামলার পর পুলিশ এবং র্যাব যৌথভাবে ছায়া তদন্ত শুরু করে। রাজিউরের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বেও একাধিক প্রতারণার মামলা ছিল এবং তিনি একাধিকবার জেলও খেটেছেন বলে তথ্য উঠে আসে।
র্যাব-৫ এর সিপিএসসি এবং র্যাব-১৩ এর সিপিসি-১-এর একটি চৌকস টিম মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার অনুরোধে গত ১২ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে ঠাকুরগাঁও সদর থানার বন্দরপাড়া এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে রাজিউর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাজিউর রহমান তার অপরাধের কথা স্বীকার করেন। তিনি জানান, পুলিশের পরিচয় দিয়ে বহুবার প্রতারণা করেছেন। বিভিন্ন সময়ে সাধারণ মানুষকে চাকরি, ট্রান্সফার, নিয়োগপত্র দেওয়ার নামে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
তার এই প্রতারণা পদ্ধতির মধ্যে ছিল—জাল সার্টিফিকেট তৈরি, ব্ল্যাঙ্ক চেক ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সংগ্রহ করে ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা।
বিশেষ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করে অনেক নিরীহ পরিবারের স্বপ্ন ভেঙেছেন তিনি।
জানা গেছে, প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত অর্থে রাজিউর বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। নিজ এলাকায় তিনি পুলিশের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যাতে সাধারণ মানুষ সহজে তার ফাঁদে পা দেয়। তার বিরুদ্ধে এর আগেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশই ছিল চাকরি দেওয়ার নাম করে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাত সংক্রান্ত।
গ্রেফতারকৃত রাজিউর রহমানকে পরবর্তীতে রাজশাহী মহানগরের বোয়ালিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রতারণা আইনে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং অতীত মামলাগুলোর তদন্তও নতুন করে শুরু করা হতে পারে বলে জানিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এই ঘটনা আবারও প্রমাণ করে, সরকারি চাকরি বা সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীর প্রলোভনে পড়া কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। প্রতারক চক্রগুলোর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হলে সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন ও সতর্ক হতে হবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়োগে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণ করে। কারও মাধ্যমে বা অর্থের বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই—এই বার্তাটি সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি।