নিউজ রিপোর্টার ডেস্ক |
বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল শুধু তার স্বাদ, ঘ্রাণ আর মিষ্টি রসালো গঠন দিয়েই নয়, বরং স্বাস্থ্য উপকারিতার কারণেও অনন্য। এক সময় গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়ির উঠোনে দেখা যেত কাঁঠালের গাছ। আজও এই দেশি ফলটির কদর কমেনি। বরং, আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞান বলছে—কাঁঠাল মানবদেহের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ পুষ্টির উৎস।
এই মৌসুমে যখন বাজার ভরে উঠেছে পাকা কাঁঠালে, তখন চলুন জেনে নিই কাঁঠালের পুষ্টিগুণ, চিকিৎসাগত উপকারিতা, খাদ্য ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এর বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব, এবং কিছু সাবধানতা।
কাঁঠাল একটি শক্তির উৎস ফল। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা কাঁঠালে প্রায় ৯৫ কিলোক্যালরি শক্তি, প্রচুর পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন ‘সি’, ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘বি৬’, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ফাইবার থাকে। এতে কোন চর্বি বা কোলেস্টেরল নেই, যা একে একটি হৃদয়বান্ধব ফল হিসেবে গড়ে তোলে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি মাঝারি আকারের কাঁঠাল থেকে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ তার দৈনিক ক্যালোরি ও ভিটামিন-সি চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করতে পারে।
কাঁঠালে থাকা উচ্চমাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন ‘সি’ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। এটি সর্দি-কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ভাইরাস সংক্রমণ ও নানা সংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমায়।
বিশেষ করে বর্ষাকালে যখন ভাইরাল জ্বর, ঠান্ডা, গলা ব্যথার প্রকোপ বাড়ে, তখন নিয়মিত কাঁঠাল খেলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম আরও সক্রিয় থাকে।
কাঁঠালে রয়েছে উচ্চমাত্রার ডায়েটারি ফাইবার, যা পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, পেটের গ্যাস কমায় এবং পাচনতন্ত্র সুস্থ রাখে।
যাদের হজমের সমস্যা আছে বা বারবার গ্যাস্ট্রিক-অম্বলে ভোগেন, তাদের জন্য কাঁঠাল হতে পারে একটি প্রাকৃতিক সমাধান।
কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। রক্তনালীগুলোকে চাপমুক্ত রেখে হৃদযন্ত্র ভালোভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। এতে কোলেস্টেরল বা ট্রান্স ফ্যাট নেই, তাই এটি হৃদরোগীদের জন্য একটি নিরাপদ ফল।
ভিটামিন ‘এ’ ও বিটা-ক্যারোটিন সমৃদ্ধ কাঁঠাল চোখের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে সাহায্য করে, রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে এবং চোখকে আলোর সংবেদনশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
এছাড়া কাঁঠালের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান ত্বকে বয়সের ছাপ পড়া রোধ করে এবং ত্বককে উজ্জ্বল রাখতে সাহায্য করে।
কাঁঠালের নরম অংশ সহজপাচ্য হওয়ায় শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এটি একটি উপযুক্ত ফল। শিশুর বৃদ্ধিতে ও রোগ প্রতিরোধে কাঁঠালের ভুমিকা রয়েছে। আর বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এটি হাড়ের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম সরবরাহ করে।
এ ফলটি প্রাকৃতিক চিনি—গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজে সমৃদ্ধ। তাই এটি তাৎক্ষণিক শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। খেলোয়াড়, মজুর কিংবা যারা দৈহিক পরিশ্রম করেন, তাদের জন্য এটি আদর্শ একটি মৌসুমি ফল।
কাঁঠালে রয়েছে ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা দেহের কোষকে রক্ষা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই উপাদানগুলো টিউমার কোষ গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।
শুধু ফল নয়, কাঁঠালের বীজেও রয়েছে প্রোটিন, আয়রন ও মিনারেল। এটি সিদ্ধ করে কিংবা শুকিয়ে গুড়ো করে খেলে শরীরের আয়রনের ঘাটতি পূরণে সহায়তা করে। গৃহস্থালি রান্নায়ও এর বহুল ব্যবহার দেখা যায়।
যদিও কাঁঠাল অত্যন্ত উপকারী, তবে অতিরিক্ত খাওয়া উল্টো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বেশি খেলে গ্যাস্ট্রিক হতে পারে, কারো কারো ডায়াবেটিসে প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে পাকা কাঁঠালে উচ্চ গ্লুকোজ থাকার কারণে।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য তাই এটি সীমিত পরিমাণে খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা।
কাঁঠাল শুধু ফল হিসেবে খাওয়া নয়—এর মোচার তরকারি, বীজ দিয়ে ভর্তা, সিদ্ধ বা ভাজি, শুকিয়ে চিপস ইত্যাদি বহু উপায়ে রান্না ও সংরক্ষণ করা যায়। পাকা কাঁঠালের আচার বা জেলিও জনপ্রিয়।
১৯৮০ সালে কাঁঠালকে বাংলাদেশের জাতীয় ফল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি শুধু খাদ্য নয়, আমাদের সংস্কৃতির অংশ। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস মানেই কাঁঠালের মৌসুম। বাঙালির ঘ্রাণ, স্বাদ আর ঐতিহ্যে কাঁঠালের আলাদা এক স্থান রয়েছে।
পুষ্টিকর, সহজলভ্য এবং উপকারী—এই তিন বৈশিষ্ট্যের সম্মিলনেই কাঁঠাল বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফল। তাই চলুন, প্রাকৃতিক পুষ্টির এই ভাণ্ডারকে আমাদের খাদ্যতালিকায় স্থান দিই। নিয়মিত কাঁঠাল খেয়ে শরীর থাকুক সুস্থ, মন থাকুক সতেজ।