রাজশাহী প্রতিনিধি:
রাজধানীর উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো শিক্ষার্থীদের মৃত্যুতে রাজশাহী বরেন্দ্র প্রেসক্লাব গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছে। দুর্ঘটনায় এ পর্যন্ত ২৭ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন এবং শতাধিক আহত অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এই মর্মান্তিক ঘটনায় জাতি গভীরভাবে শোকাহত।
২১ জুলাই (সোমবার) দুপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়। তখন শ্রেণিকক্ষে প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। দুর্ঘটনার তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে মুহূর্তেই পুরো ভবনে আগুন ধরে যায় এবং প্রাণ হারায় বহু কোমলমতি শিক্ষার্থী। ঘটনায় তাৎক্ষণিক উদ্ধার কার্যক্রম চালানো হয় এবং আহতদের স্থানীয় হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়।
এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় ২২ জুলাই (মঙ্গলবার) এক বিবৃতিতে রাজশাহী বরেন্দ্র প্রেসক্লাবের সভাপতি শামসুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সহ নির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে গভীর শোক ও সহানুভূতি প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রেসক্লাবের বিবৃতিতে বলা হয়:
“এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমাদের সবাইকে ব্যথিত ও শোকাহত করেছে। অল্প বয়সী শিক্ষার্থীদের অকাল মৃত্যু কখনোই পূরণ হওয়ার মতো ক্ষতি নয়। আমরা নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার, স্বজন ও সহপাঠীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। সেইসাথে আহত শিক্ষার্থীদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।”
প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে আরও বলা হয়,
“দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই আমাদের নতুন প্রজন্মকে আলোকিত করে গড়ে তোলে। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের দুর্ঘটনা শুধু একটি পরিবারের নয়, বরং সমগ্র জাতির জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিরাপদ রাখতে আমাদের সবারই আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।”
তদন্ত ও দায় নিরূপণের জোর দাবি:
বরেন্দ্র প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষ এ দুর্ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত ও দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়,
“আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি—দ্রুত একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ নির্ধারণ করা হোক। একইসাথে ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের দুর্ঘটনা আর না ঘটে সে বিষয়ে কার্যকর, সময়োপযোগী ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।”
এই দুর্ঘটনায় কেবল শিক্ষার্থীই নয়, শিক্ষক, স্টাফ ও আশপাশের বাসিন্দারাও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস, বিমানবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা একযোগে কাজ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় বিভীষিকাময় দৃশ্য:
ঘটনাস্থলে থাকা এক শিক্ষার্থী বলেন, “হঠাৎ আকাশ থেকে বিমানটি নিচে নামতে দেখে সবাই চিৎকার করে দৌড়াতে থাকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি বিকট শব্দ হয়, এরপর সব দিক আগুনে ভরে যায়। সহপাঠীদের আর খুঁজে পাইনি।”
শিক্ষার্থীদের স্বজনদের আহাজারি:
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের খোঁজে স্বজনেরা পাগলের মতো ছুটছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে। সন্তানকে হারিয়ে এক মা কান্নারত অবস্থায় বলেন, “সকালে আমার ছেলে বলেছিল, মা আজ নতুন ক্লাসে যাবে। কে জানত ওর জীবনের শেষ দিন এটা!”
সারাদেশে শোকের ছায়া:
এই দুর্ঘটনা কেবল উত্তরা নয়, পুরো দেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলো একের পর এক শোকবার্তা প্রকাশ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভাইরাল হয়ে পড়েছে ঘটনাস্থলের ছবি ও ভিডিও, যা দেখে শোকস্তব্ধ পুরো জাতি।
রাজশাহীতেও এই দুর্ঘটনার তীব্র প্রভাব পড়েছে। বরেন্দ্র প্রেসক্লাব ছাড়াও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিক সংগঠনগুলো শোক প্রকাশ করেছে এবং নিহতদের স্মরণে দোয়া মাহফিল ও মোমবাতি প্রজ্বালনের আয়োজন করেছে।
প্রেসক্লাবের সমবেদনা বার্তায় আরও বলা হয়:
“জাতির এই দুঃখের মুহূর্তে আমরা নিহতদের পরিবারের পাশে আছি। এমন হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা যেন আর কখনও না ঘটে, সে জন্য জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।”
সরকারিভাবে দুর্ঘটনার তদন্তে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে চূড়ান্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক শোকবার্তায় নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করেছেন এবং আহতদের সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এই দুর্ঘটনা আমাদের সবার জন্যই বেদনাদায়ক। সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহায়তা করা হবে।”
উত্তরার এই বিমান দুর্ঘটনা একটি করুণ স্মৃতি হয়ে থাকবে দেশের শিক্ষা, প্রশাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ইতিহাসে। রাজশাহী বরেন্দ্র প্রেসক্লাবের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও যে মানবিকভাবে এগিয়ে এসেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু একইসাথে এটি একটি বড় প্রশ্নও উত্থাপন করে—নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোথায় ঘাটতি ছিল? সেই উত্তর খুঁজতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।