আলমগীর হোসেন সাগর
স্টাফ রিপোর্টার
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় এক হৃদয়বিদারক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন মাসুদ রানা (৪৫) নামের এক পিতা। এই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন তাঁর দুই স্কুলপড়ুয়া মেয়ে মাহিমা ও তনিমা। তাঁরা তিনজনই ঢাকার উত্তরা মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত ঘটনায় হতাহতদের জন্য আয়োজিত দোয়া মাহফিলে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) দুপুরে গাজীপুর ইউনিয়নের নয়নপুর এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মাওনা চৌরাস্তার ন্যাশনাল মেরিট একাডেমিতে পৌঁছাতে মাসুদ রানা মোটরসাইকেলে করে তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে নয়নপুর বাজার এলাকায় একটি দ্রুতগতির কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় মোটরসাইকেলটির।
দোয়া মাহফিলের উদ্দেশ্যে যাত্রা, পথে প্রাণ হারালেন বাবা
স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল ইসলাম জানান, “মাসুদ রানা তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে মাইলস্টোনে নিহত-আহতদের জন্য আয়োজিত দোয়া মাহফিলে অংশ নিতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি কাভার্ড ভ্যান বিপরীত দিক থেকে এসে মুখোমুখি ধাক্কা দেয়। তারা তিনজনই ছিটকে পড়ে যায়। মাসুদ রানার মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে এবং ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।”
গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁর দুই মেয়ে মাহিমা ও তনিমাকে প্রথমে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত তাঁদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতাল সূত্র জানায়, আহত দুই বোনের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ন্যাশনাল মেরিট একাডেমির পরিচালক বলেন
ন্যাশনাল মেরিট একাডেমির পরিচালক মো. সাহাবউদ্দিন ফরাজী বলেন, “মাইলস্টোন দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের স্মরণে আমরা একটি দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছিলাম। আমাদের স্কুলের দুই শিক্ষার্থী তাদের বাবার সঙ্গে এই দোয়া মাহফিলে অংশ নিতে আসছিল। দুঃখজনকভাবে পথে এই দুর্ঘটনায় তাদের পিতা প্রাণ হারান। আমরা শোকাহত।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা আহত দুই শিক্ষার্থীর দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তাঁদের পরিবারকে সকল প্রকার সহযোগিতা করা হবে।”
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বক্তব্য
মাওনা হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আয়ুব আলী বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত পুলিশ পাঠানো হয়। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কাভার্ড ভ্যানটি জব্দ করা হয়েছে এবং চালককে আটক করা হয়েছে। নিহতের স্বজনদের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে।”
তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মহাসড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা জোরদার করা হবে। অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়া চালনার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।”
পরিবারের আহাজারি, এলাকায় শোকের ছায়া
মাসুদ রানার মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে শোকের মাতম। তাঁর আত্মীয় স্বজনেরা জানান, তিনি ছিলেন একজন আদর্শ পিতা। সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। এমন একটি মহৎ উদ্দেশ্যে বের হয়ে জীবনের শেষ পথ পাড়ি দিতে হবে—এমন দুর্ভাগ্য কেউ কল্পনাও করেনি।
শ্রীপুরের নয়নপুর এলাকায় নিহতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী ও এলাকাবাসী শোকে পাথর হয়ে গেছেন। সন্তানদের সামনে পিতা প্রাণ হারানোর মর্মন্তুদ এই দৃশ্য সবাইকে নাড়া দিয়েছে। প্রতিবেশীরা জানায়, মাসুদ রানা ছিলেন একজন ভদ্র, নম্র ও সৎ ব্যক্তি। তাঁর এমন মৃত্যু পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নামিয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের সংখ্যা বাড়ছেই
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন সড়কে দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কে নজরদারি, চালকদের প্রশিক্ষণ, ওভারস্পিড নিয়ন্ত্রণ এবং পথচারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি চালকদের লাইসেন্স যাচাই প্রক্রিয়াও কঠোরভাবে পরিচালনা করতে হবে।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ ও শোকবার্তা
এই ঘটনার পর স্থানীয় সাংবাদিক, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা সামাজিক মাধ্যমে গভীর শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা লিখেছেন—“একজন পিতা তাঁর সন্তানের সঙ্গে নির্দোষভাবে দোয়া মাহফিলে যাচ্ছিলেন, অথচ রাস্তার বেপরোয়া গতির বলি হয়ে প্রাণ হারালেন। এর জবাব কে দেবে?”
অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, “দেশের সড়কগুলো কবে নিরাপদ হবে? কত প্রাণ হারালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে?” এরই মধ্যে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দৃষ্টি আকর্ষণ করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছে।
শোক ও দোয়া মাহফিলে দোয়া হয় নিহত মাসুদ রানার জন্যও
ন্যাশনাল মেরিট একাডেমিতে অনুষ্ঠিত দোয়া মাহফিলে দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। মুহূর্তেই পুরো মিলনায়তনে নেমে আসে শোকের স্তব্ধতা। দোয়া মাহফিল পরিচালনাকারী শিক্ষক নিহত মাসুদ রানার আত্মার মাগফিরাত ও তাঁর দুই কন্যার সুস্থতা কামনা করে বিশেষ দোয়া পরিচালনা করেন।