রাজশাহী ব্যুরোঃ
বিয়ের নামে প্রতারণা করে বছরের পর বছর ধরে আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপনে থাকা রাজশাহীর আলোচিত নিকাহ রেজিস্ট্রার কাজী মোকাদ্দিম হোসেন ওরফে শাওন (৪০)–কে অবশেষে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-৫।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাত ১০টার দিকে রাজশাহী মহানগরীর রাজপাড়া থানাধীন ডিঙ্গাডোবা ঈদগাঁ এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই পলাতক ছিলেন এবং পরিচয় গোপন রেখে আত্মগোপনে ছিলেন বলে জানিয়েছে র্যাব।
র্যাব-৫ এর রাজশাহী সদর কোম্পানির একটি বিশেষ অপারেশন দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এই অভিযান চালায়। অভিযানে নেতৃত্ব দেন কোম্পানি কমান্ডার মেজর সানজিদুল আলম।
র্যাব জানায়, কাজী শাওনের বিরুদ্ধে সিআর মামলা নং-৩৯৯/১৯ (মোহনপুর থানা), দণ্ডবিধির ৪১৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/৩৪ ধারায় প্রতারণা, জালিয়াতি ও কাগজপত্র জাল করার অভিযোগ রয়েছে। তিনি বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন অবৈধভাবে সম্পন্ন করতেন। কখনও এক পক্ষের সম্মতি ছাড়াই, কখনও জাল স্বাক্ষর কিংবা মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করে এসব বিয়ে রেজিস্ট্রি করতেন।
এইসব কার্যকলাপের ফলে একাধিক নারী এবং তাদের পরিবার পড়েন প্রতারণার ফাঁদে। অনেকে সামাজিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হন। মামলার বাদীদের ভাষ্য মতে, শাওনের অবৈধ বিয়ে রেজিস্ট্রির কারণে বহু পরিবারে ভাঙন ধরেছে। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
নিরাপত্তার স্বার্থে মামলা দায়েরকারীদের নাম প্রকাশ না করা হলেও র্যাব জানিয়েছে, ভুক্তভোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই সামাজিকভাবে প্রান্তিক ও অপ্রতুল আইনি সহায়তার অধিকারী। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কাজী শাওন বছরের পর বছর অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জন করে গা-ঢাকা দেন।
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর তিনি তার পেশা ও পরিচয় গোপন করে রাজপাড়া থানাধীন ডিঙ্গাডোবা এলাকায় আত্মগোপনে থাকেন। স্থানীয়ভাবে তিনি একজন ভদ্র ও নিরীহ লোক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন।
তবে গোপন সূত্রে র্যাব জানতে পারে, এই এলাকাতেই তিনি ভাড়া বাসায় অবস্থান করছেন। পরে বৃহস্পতিবার রাতে অভিযানে তাকে আটক করা হয়।
গ্রেফতার পরবর্তী প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কাজী শাওন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি স্বীকার করেন, বিয়ের রেজিস্ট্রি করে বিভিন্ন পরিবার ও নারীকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে তিনি মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
র্যাব-৫ এর এক কর্মকর্তা জানান, “তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে সংক্রান্ত ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে প্রতারণা করে আসছিলেন। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজের সুবিধা আদায়ই ছিল তার মূল লক্ষ্য।”
গ্রেফতারের পর তাকে রাজশাহীর মোহনপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়। থানার ওসি জানান, “আমরা শাওনকে র্যাবের মাধ্যমে পেয়েছি এবং তার বিরুদ্ধে আদালতের পরোয়ানার ভিত্তিতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তদন্ত চলমান রয়েছে, প্রয়োজনে আরও ভুক্তভোগীদের বক্তব্য নেয়া হবে।”
র্যাব-৫ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, “দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতারণাসহ সব ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে।”
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কাজী শাওন এতদিন এলাকাতেই ছিলেন কিন্তু তার প্রকৃত পরিচয় কেউ জানত না। তার গ্রেফতারে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
এক ভুক্তভোগীর অভিভাবক বলেন, “আমার মেয়ের জীবনে যা ঘটেছে, তার জন্য এই কাজী শাওনই দায়ী। আমি চাই তার কঠোর শাস্তি হোক, যাতে আর কেউ এমন প্রতারণা করতে না পারে।”
সামাজিক সংগঠন ও নারী অধিকারকর্মীরাও কাজী শাওনের গ্রেফতারকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের দাবি, এই ধরনের প্রতারকদের কঠোর সাজা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যতে এমন অপকর্ম করার সাহস না পায়।
কাজী শাওনের গ্রেফতার রাজশাহীতে প্রতারণা চক্রের বিরুদ্ধে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তার মাধ্যমে যদি আরও কোনো প্রতারণা চক্রের সন্ধান মেলে, তবে প্রশাসন তা কঠোরভাবে দমন করবে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে র্যাব।
আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কেউই বেশি দিন লুকিয়ে থাকতে পারে না—কাজী শাওনের ঘটনা সেটির বড় প্রমাণ। সাধারণ মানুষের সহায়তায় এবং গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতায় প্রতারণাকারীদের মুখোশ খুলে দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।