মুহাম্মদ আবু হেলাল, শেরপুর প্রতিনিধি:
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক বাংলাদেশে রোহিঙ্গা পুশইন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) দিবাগত রাত সোয়া ১টার দিকে বিএসএফ সদস্যরা আবারও ৬টি পরিবারের ২১ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পুশইন করেছে। সীমান্তের ১১১৬ নম্বর মেইন পিলার এলাকা দিয়ে এই পুশইন ঘটনাটি ঘটে বলে নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, পুশইন হওয়া ২১ জনের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পাঁচজন, নারী পাঁচজন এবং শিশু ১১ জন রয়েছে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্গত কিলাপাড়া বিএসএফ ক্যাম্প থেকে এই পুশইন কার্যক্রম চালানো হয়। ঘটনাটি ঘটার পরপরই নাকুগাঁওয়ের হাতিপাগাড় ক্যাম্পের আওতাধীন বিজিবির একটি টহল দল তাৎক্ষণিকভাবে তাদের আটক করে এবং স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিরাপদ হেফাজতে রাখে।
৩৯ বিজিবির ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদি হাসান এ বিষয়ে বলেন, “পুশইন হওয়া ব্যক্তিরা রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্য। বর্তমানে তাদের পরিচয় ও অতীত কর্মকাণ্ড যাচাই-বাছাই চলছে। পাশাপাশি পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে।”
উল্লেখ্য, এর আগেও চলতি জুলাই মাসের ১১ তারিখে একই উপজেলার পানিহাতা সীমান্ত দিয়ে ১০ জন নারী ও শিশুকে পুশইন করে বিএসএফ। চলমান এই পুশইন কার্যক্রম সীমান্ত এলাকায় আতঙ্ক ও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে।
বিজিবি ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, পুশইন হওয়া ২১ জন রোহিঙ্গা ২০১৭ সালে মিয়ানমারে সেনা অভিযানের পর পালিয়ে বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে ওই শরণার্থী ক্যাম্প থেকে সুযোগ পেয়ে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে তারা ভারতের জম্মু-কাশ্মীরে চলে যায়। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে তারা শ্রমিক হিসেবে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বাসাবাড়িতে কাজ করছিল।
তবে এক মাস আগে ভারতীয় পুলিশ এক অভিযান চালিয়ে তাদেরকে আটক করে। পরবর্তীতে যাচাই-বাছাইয়ের সময় তারা নিজেদের রোহিঙ্গা বলে স্বীকার করে এবং বাংলাদেশের উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাসের তথ্য দেয়। ভারতীয় পুলিশ তাদের বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর বিএসএফ তাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পুশইন করে।
এই ধরনের পুশইন কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক সীমান্ত নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোনো দেশ তার সীমান্তবর্তী রাষ্ট্রে কাউকে জোর করে পাঠাতে পারে না যদি না উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিকভাবে তা সমঝোতার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের মতো রাষ্ট্রহীন, নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে কোনো ধরনের নোটিশ বা আলোচনা ছাড়া পুশইন করাকে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মতে, এই ধরনের পুশইন রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত জীবনযাত্রাকে আরও বিপদসংকুল করে তোলে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ায়।
নাকুগাঁও সীমান্ত এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এইভাবে হঠাৎ করে বারবার রোহিঙ্গা পুশইনের ঘটনায় তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। একদিকে মানবিক বিষয়, অন্যদিকে নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ– দুটোরই সম্মুখীন তারা।
স্থানীয় একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা নিজেরাই সীমান্তে নানা সমস্যার মধ্যে থাকি। এর ওপর যদি বারবার রোহিঙ্গারা পুশইন হয়ে আসে, তাহলে আমাদের জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠবে। সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।”
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, পুশইন হওয়া রোহিঙ্গাদের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এসব রোহিঙ্গাদের নিরাপদ হেফাজতে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
শেরপুরের জেলা প্রশাসক বলেন, “বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তা ও মানবাধিকার উভয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমরা বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কার্যক্রম চালাচ্ছি।”
বাংলাদেশ সরকার আগে থেকেই ভারতের একতরফা পুশইনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একাধিকবার কূটনৈতিক চ্যানেলে ভারতের প্রতি এই ধরনের কার্যক্রম বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তবে বাস্তবে এই পুশইন কার্যক্রম থামছে না।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের প্রতি কড়াকড়ি নীতির কারণে তারা সেসব রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। এতে করে একদিকে যেমন রোহিঙ্গা সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে, অন্যদিকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।
রোহিঙ্গা পুশইনের ঘটনা শুধু সীমান্ত বা নিরাপত্তাজনিত সমস্যা নয়; এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতি, মানবিকতা ও আঞ্চলিক সম্পর্কের জটিল চিত্র। এই ধরনের পুশইন রোধে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলের নজর আকর্ষণ করে যৌথভাবে এই সংকটের স্থায়ী সমাধানের পথে অগ্রসর হতে হবে।