মোঃ বেল্লাল হোসাইন নাঈম
স্টাফ রিপোর্টার
নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলায় এক হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্ম হয়েছে। নিখোঁজের দুইদিন পর মেঘা খাল থেকে ১৪ বছর বয়সী মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু আরিফ হোসেনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ। কিশোর আরিফের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে স্থানীয়দের মাঝে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। পরিবারের দাবি এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, অন্যদিকে পুলিশ বলছে ময়নাতদন্তের আগে কিছু বলা যাচ্ছে না।
ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা, পরিবারের প্রতিক্রিয়া, পুলিশের তদন্ত, এলাকাবাসীর মতামত এবং মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে গঠিত সামাজিক ও প্রশাসনিক অবহেলা ইত্যাদি বিষয়ের বিশ্লেষণে তৈরি এই দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।
১৪ বছর বয়সী আরিফ হোসেন ছিলেন জন্মগতভাবে মানসিক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। চাটখিল উপজেলার পরকোট ইউনিয়নের পাটোয়ারী বাড়ির বাসিন্দা জামাল হোসেনের ছেলে সে। প্রতিবেশীদের মতে, আরিফ ছিলেন শান্ত স্বভাবের, তবে মাঝে মাঝে আচরণে ভারসাম্য থাকত না। প্রায়ই দেখা যেত, রাতের বেলা বাড়িতে না থেকে আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। তবে এসব ছিল সাধারণ ঘটনা, যার ফলে পরিবারও খুব বেশি দুশ্চিন্তা করত না।
কিন্তু গত শনিবার রাতের (১২ জুলাই) ঘটনা ছিল ভিন্ন। সেদিন রাতেও আরিফ বাড়ি ফিরে আসেনি। ভোর হওয়ার পরও তার কোনো খোঁজ না পেয়ে পরিবার চিন্তিত হয়ে ওঠে। শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে স্থানীয় বাজার, দোকান ও মসজিদে খোঁজ নেওয়া হয়। তবু তার কোনো সন্ধান মেলেনি।
দুইদিনের উৎকণ্ঠার অবসান হয় এক মর্মান্তিক আবিষ্কারে। সোমবার (১৪ জুলাই) সকালে উপজেলার বদলকোট ইউনিয়নের মেঘা খালে স্থানীয় লোকজন একটি মরদেহ ভাসতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অনেকে প্রথমে ভেবেছিল খালে হয়তো কোনো পশুর মৃতদেহ ভাসছে। পরে কাছে গিয়ে দেখে এটি একজন কিশোরের নিথর দেহ।
তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বরে (৯৯৯) কল করা হয়। খবর পেয়ে চাটখিল থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং মরদেহটি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। ঘটনাটি মুহূর্তেই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নিহত শিশুর বাবা জামাল হোসেন ছবি দেখে সনাক্ত করতে পারেননি। তবে পরে নিহতের মা থানায় গিয়ে মরদেহটি দেখে আরিফের পরিচয় নিশ্চিত করেন।
আরিফের এক চাচা দাবি করেন, “আরিফ মাঝে মধ্যে ঘুরতে যেত, কিন্তু কাউকে ক্ষতি করার মানুষ ছিল না। হয়তো সে কারো বাড়িতে ঢুকতে গিয়েছিল, আর তাতে কেউ তাকে ভুল বুঝে পিটিয়ে মারছে।” তার মতে, এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং কোনো না কোনোভাবে তাকে হত্যা করে মরদেহটি খালে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
আরিফের মায়ের কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেছিলেন, “আমার ছেলে প্রতিবন্ধী ছিল, সে কারও সাথে ঝগড়া করত না। তার তো কেউ শত্রু থাকার কথা না। তাকে কিভাবে মেরে ফেলা হলো?”
চাটখিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ফিরোজ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “মরদেহটি খালের পানিতে উপুড় হয়ে ছিল। ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশে ফুলে ওঠার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো আঘাত শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। শরীরে দৃশ্যত কোনো মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন নেই। তবে সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য মরদেহটি ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “পরিবার যদি অভিযোগ দেয় তাহলে আমরা তদন্ত করব। এখনো কোনো মামলা হয়নি। রিপোর্ট পাওয়ার পরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এটি দুর্ঘটনা না কি অন্য কিছু।”
মেঘা খালের পাশের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, আরিফ নামের ছেলেটিকে আগেও তারা এলাকায় দেখেছেন। অনেক সময় হাসিমুখে গ্রামের বিভিন্ন দোকানে বসে থাকত বা ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে খেলত। তারা অবাক হয়েই বলছেন, “এই ছেলেটা তো কারও ক্ষতি করত না, তাহলে তার এভাবে মৃত্যু হলো কেন?”
স্থানীয় এক ইউপি সদস্য বলেন, “আমাদের এলাকায় এই ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। আমরা চাই প্রশাসন তদন্ত করে দেখুক এটি দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা না কি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।”
এই ঘটনার পর আবারও আলোচনায় এসেছে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের নিরাপত্তা ও অধিকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের শিশুরা পরিবার ও সমাজ উভয়ের পক্ষ থেকে উপযুক্ত সহায়তা ও সুরক্ষা পায় না। সামাজিক অবহেলা ও সচেতনতার অভাবে তারা প্রায়ই নিগৃহীত বা উপেক্ষিত হয়।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বলছে, “আরিফের মৃত্যু একটি বড় ইঙ্গিত—আমরা এখনো প্রতিবন্ধী শিশুদের সুরক্ষায় যথেষ্ট নয়। এই ঘটনায় যদি সত্যিই কোনো নির্যাতনের প্রমাণ মেলে তবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।”
চাটখিল উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলেই পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বলেন, “আমরা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছি। প্রতিবন্ধী শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সামাজিক সচেতনতামূলক উদ্যোগও নেওয়া হবে।”
তিনি আরও জানান, এলাকায় এখন থেকে ভ্রাম্যমাণ মনিটরিং টিম গঠন করা হবে, যারা বিশেষভাবে শিশু ও নারী নিরাপত্তায় কাজ করবে।
আরিফ হোসেনের অকাল মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটি আমাদের সমাজের একটি গভীর সমস্যার প্রতিচ্ছবি। প্রতিবন্ধী শিশুদের নিরাপত্তা, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশাসনিক তৎপরতা এবং পারিবারিক সচেতনতার অভাব—সবকিছু মিলিয়ে এমন এক শূন্যতা তৈরি করে যা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।
এই ঘটনার প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের জন্য যেমন নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন, তেমনি ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে আমাদের সামাজিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা আরও সংবেদনশীল ও সক্রিয় হওয়া জরুরি।